————- হুমায়ুন কবির, পুলিশ কর্মকর্তা :
বর্তমানে অপরাধীদের প্রায় ৯০ শতাংশই মাদকসেবী। সারাদেশ জুড়ে মাদকের ভয়াবহ রূপ দেখে উদ্বিগ্ন প্রতিটি বাবা-মা এবং অভিভাবকরা। মাদক শুধু একটি জীবনকেই তিলে তিলে শেষ করেনা, কেঁড়ে নেয় সারা জীবনের জন্য তার পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মুখের হাসি, ভেঙ্গে চুরমার করে দেয় ঐ পরিবারের লালিত স্বপ্নকে, গুড়িয়ে দেয় পরিবারের সুখ শান্তিকে, তছনছ করে দেয় পারিবারিক অবস্থান, ঐতিহ্য আর মান-সম্মানকে। এভাবেই পরিবার থেকে সমাজ এবং গোটা দেশকে মাদকের বিষাক্ত ছোঁবল শেষ করে দেয়।
খানিকটা ভাবলেই বুঝতে পারবেন, আমাদের সমাজে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়। কোন অপরাধ গোটা দেশের মেধা বিনষ্ট করে? কোন অপরাধ গোটা জাতির ভবিষ্যৎ তিমির কালোতে ঢেকে দেয়? কোন অপরাধ কর্মের ফলে গোটা জাতিকে উদ্বিগ্ন আর হতাশায় আচ্ছন্ন থাকতে হয়? আপনাদের জবাবটা দেবেন, “নিশ্চয়ই মাদক ছাড়া অন্য কোনটি নয়। তাই যদি হয়, তাহলে এটাকে রাজনৈতিক রূপান্তর করা বুদ্ধিমানের কাজ বলে সাধারণ জনগণ সমর্থন করবে না। মাদক প্রতিরোধ বা নির্মূলের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে কার কার উপকার হবে, তা কি ভেবে করছেন? যারা সুন্দর এ দেশটাকে ধ্বংস করে বানাচ্ছে অট্টালিকা, যারা গোটা দেশের হাসি, সুখ-শান্তি কেড়ে নিয়ে নিজে সুখ-শান্তি খোঁজেন। যারা মাদক ব্যবসায়ীর উপার্জনে জীবিকানির্বাহ করেন কিংবা মাদক ব্যবসায়ীর গডফাদার হিসেবে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাচ্ছেন। মাদক ব্যবসা বন্ধ হলে যাদের উপার্জনে ধ্বস নামবে তাদের সংখ্যা একদম নগণ্য। যা মোট জনসংখ্যার ২ থেকে ৩ ভাগের বেশি হবেনা। যাদের লালসার শিকার গোটা দেশ ও জাতি।
সাধারণত প্রতিবেশীর সাথেই আমাদের শত্রুতার সূত্রপাত ঘটে। বোধ হয়, পরীক্ষায় পাশের জন্যই আমরা মুখস্থ করেছিলাম :
★অহিংসা পরম ধর্ম।
★হিংসা পতনের মূল।
★অন্যের অনিষ্টকারীকে অাল্লাহ পছন্দ করেন না
ইত্যাদি চিরন্তন সত্যকেও আমরা হার মানাচ্ছি শক্তি ও ক্ষমতা দিয়ে।
আমরা ভূলে বসি আছি
★আল্লাহ সর্ব শক্তিমান।
মনে রাখি না আল্লাহর বাণী,
★আল্লাহ তাকেই ভালবাসেন, যিনি ভালবাসেন তাঁর সৃষ্টিকে।
ভূলে যাই,
★জীবে দয়া করে যে জন, সে জন সেবিছে ঈশ্বর,
★ ভোগে নয়, ত্যাগেই মুক্তি।
★ কোথায় স্বর্গ? কোথায় নরক? কে বলে তা বহুদূর?
মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতে সুরাসুর। ★দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য।
★ চরিত্র মূল্যবান সম্পদ।
★ চরিত্র জীবনের মুকুট।,
★ চরিত্রহীন লোক পশুর সমান।
★ মিথ্যা বলা মহাপাপ।
★ লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু ইত্যাদি।
এসবের কোন মূল্য নেই এখন। পাস করতেই হবে এমন কোন পরীক্ষা আর ভবিষ্যতে দিতে হবেনা। কারন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে সবচেয়ে বড় ডিগ্রীটি নিয়ে আজ আমরা সবার উপরে আসীন।এজন্যই হয়তো, প্রতিবেশীর উন্নতি দেখলে আমাদের চোখ কপালে উঠে আসে, প্রতিবেশীর সুখ দেখলে, বেজায় কষ্ট পাই মনে মনে। প্রতিবেশীর হাসিতে কানে জ্বালাপোড়া ধরে। প্রতিবেশীর মুখোমুখি হলে তার হাসি-খুশিতে আমিও তাকে দেখানোর জন্য মুখ বাঁকা করি, কিন্তু হাসতে পারি না।
এদেশ আমাদের মা, আমাদের অস্তিত্ব। এদেশে জন্মেছি বলেই আমরা গর্ব করে বলতে পারি।এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এদেশটিকে ধ্বংস করার জন্য গুটি কয়েক দুর্জন, লোভী, অসভ্য, পথভ্রষ্ট, স্বার্থপরদের হাতে মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে, অার এটাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হাতল হিসেবে শক্ত করে ধরার চেষ্টা হবে। দেশ ধ্বংসের উদ্দেশ্যে বুমেরাং হবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। মাদকের হিংস্র থাবায় বিধ্বংস সারা দেশের প্রায় প্রতিটি পরিবার। মাদকের সহজলভ্যতার কারণে উঠতি বয়সী কিশোর, যুবক, ছাত্র-ছাত্রীরা সামান্য আবেগেই মাদকসেবন শুরু করে দেয়। আর এজন্যই ক্রমান্বয়ে দিন দিন দ্বিগুন হারে বাড়ছে (যেমন–২-৪-৮-১৬-৩২-৬৪) মাদকাসক্তদের সংখ্যা বাড়ছে দেশ, জাতি ও ভবিষ্যৎ বিধ্বংসী মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যাও। মাদকের বিস্তৃতি এখন আশংকাজনক সমগ্র দেশজুড়ে। মাদকের বিষাক্ত ছোঁবলে অকাল মৃত্যুতে পতিত হচ্ছে প্রতিটি পরিবারের স্বপ্ন ও ভবিষ্যৎ। মাদকাসক্তদের প্রতিটি পরিবারের অভিভাবকের লালিত স্বপ্নেভরা হৃদয়কে বিদীর্ণ করে রক্তাক্ত করছে, স্বপ্ন মোছে গেছে হৃদপিন্ডের ক্ষতনিঃসৃত রক্তের অনুচক্রিকার ক্রিয়া মাধ্যমে জমাটবাধা রক্তের আবরণে।
★ প্রথমত : অপ্রিয় হলেও সত্য যে, এমন সর্বনাশা এই ভয়ানক অপরাধ কর্মে কোথাও কোথাও প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করে আসছে পুলিশের অসৎ ও দুর্নীতিবাজ গুটি কয়েকজন সদস্য। যারা কাড়ি-কাড়ি টাকা যোগাড়ে দিশেহারা হয়ে ঐতিহ্যবাহী এ পুলিশ বাহিনীর সুনামকে ফিকে করেছে। তাদের অপকর্মের গ্লানি টানতে টানতে বাংলাদেশ পুলিশ দম ফেলার ফুরসৎ পাচ্ছে না। কোন অসৎ সদস্যের ব্যক্তিগত অপকর্মের দায় গোটা বাহিনী কেন নেবে? কত নেব? এসব দায়ীদের চিহ্নিত করে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ আবশ্যক। স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্বপ্রথম দেশের জন্য অকাতরে প্রান দেয়া ঐতিহ্যবাহী এই বাহিনী থেকে স্থায়ীভাবে তাদেরকে বরখাস্ত করা খুব জরুরী। তবেই এ বাহিনীর ইমেজ পরিচ্ছন্নতা পাবে। পুলিশই পারবে এদেশকে সোনার বাংলায় রূপ দিতে।
দ্বিতীয়ত : অসৎ কিংবা দলবদলে কুখ্যাতি সম্পন্ন রাজনৈতিক নেতাদের সম্পৃক্ততা, যারা মাদক ব্যবসায়ীদের গডফাদারের ভূমিকা পালন করে। মাদক ব্যবসায়ীদের লভ্যাংশের প্রায় অর্ধেক তার গডফাদারকেই দিতে হয়। গডফাদার কৌশলে থানা পুলিশকে ম্যানেজের কথা বলে অন্য একটি অংকের টাকাসহ মোটের উপর সিংহভাগই হাতিয়ে নেয় দলের জন্য কলংকিত ঐ নেতা। যদি পেশাদার কোন নাছোড়বান্দা পুলিশ অফিসারের হাতে ঐ ব্যবসায়ী ধরা পড়ে। তখন মাদক ব্যবসায়ীর গিন্নী ফোন দিয়ে সিংহভাগ পাওয়া ফডফাদার জানায়।” একটু অাগে থানার নতুন দারোগা এইডা মনার বাপেরে ধইরা লইয়া গেছে, কিছু একটা করেন”। গডফাদার : তই এহন টাকা পইসা কত অাছে? যেমনেই হউক, যতই লাগুক ছাড়াইতে হইবো। আচ্ছা তাইলে ১ টেহা (১ লক্ষ) লইয়া আয়। যে কথা সে কাজ। গডফাদার টাকা পকেটে ভরে দ্রুতবেগে থানায় আসতে হয় গা ঘামিয়ে।
এসেই হতচকিত দৃষ্টিতে দেখেন ওসি সাহেবের রুম বন্ধ। সঙ্গে থাকা লোকটিকে বিড়বিড়িয়ে অনুচ্চস্বরে নিজে নিজে বলতে থাকেন, সমস্যা হলে ওসি সাবদের আর থানায় পাওয়া যায়না। দারোগা ঐডা ঘাড়তেড়া, কথা বার্তা- শুনবে না। তবে ওসি সাব আমাদের দলের লোক। আমার সাথে খাতির আছে। আমাকে দেখলেই ঐ লোককে ছেড়ে দেবে কিন্তু বিধিবাম। ওসি এসেই জানতে চায় – আপনি কে? আপনার কি উপকার করতে পারি ? ওসির এ সম্ভাষন অতিশয় মুগ্ধ হয়ে তৃপ্তির ঢেকুর গিলেন এবং পুলকিত দৃষ্টিতে মনে মনে হয়ত ভাবলেন– এতো চমৎকার ওসি ! এতদিন পর মনের মত ওসি পেলাম। নির্বিঘ্নে কামানো যাবে।
মাদক ব্যবসায়ীকে ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব দিতেই তিনি চুপ থাকলেন। ভাবলাম, কাজ হয়েছে পাক্কা ১ লাখ টাকা। কিন্তু বিধিবাম! বেরসিক ওসি ক্ষ্যাপা চেহারায় আমার দিকে তাকাতেই চেয়ারে আমার বসার জায়গাটি ভেজা ভেজা লাগছিল। বুঝে গেলাম অনেক চাপচাপি করেও মূত্রথলি হতে নির্গত Urine আটকে রাখা গেল না।
এবার মুখ খোলেন ওসি, বলেন, আপনি নিজেকে নেতা পরিচয় দিলেন বললেন ২০০ পিস ইয়াবাসহ হাতেনাতে ধৃত মাদক ব্যবসায়ীও আপনার দলের। এবার বলুন, এ দলকে সমর্থন করেন কবে থেকে? আগে কোনটিতে ছিলেন? কেনইবা দল বদল? মাদক ব্যবসায়ীকে সহযোগিতা করে অাখের গুছানো আর অপরাধীদেরকে ভাল সাজিয়ে, দলের নাম ভাঙ্গিয়ে, পূজি ছাড়া রুজি অর্থাৎ দালালী করেই দলের ভাবমূর্তিতে কালীমা লেপন করছেন, আঘাত হানছেন পুলিশের ভাবমূর্তিতেও, সর্বনাশ করছেন দেশের ভবিষ্যৎ সম্পদ নতুন প্রজন্মকে, ধ্বংস করছেন গোটা দেশকে, তবে অনেক হয়েছে, অার নয়।
তৃতীয়ত : কতিপয় অপরাধী, যারা তাদের অপরাধ কর্মকে ঢাকতে ভূয়া বা নকল ID কার্ড ঝুলিয়ে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে করছেন চাঁদাবাজি, করছেন মাদক ব্যবসাও। যারা এলাকার প্রতিটি মাদক ব্যবসায়ীকে এক একটি ব্যাংক একাউন্ট মনে করেন। মাদক কেনাবেচাসহ সকল কাজে সহযোগিতা করে সাংবাদিকতার মত জনহিতকর এই মহৎ পেশাকে কলংকিত করছেন।
লেখক : হুমায়ুন কবির, অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ফুলগাজী থানা।
★★ ( চোখ রাখুন- চলবে)★★